মাথাব্যথা একটি সাধারণ সমস্যা, যা সব বয়সের লোকেরই হয়ে থাকে। তীব্রতা এবং মাথার অবস্থানের মধ্যে তারতম্যের কারনে এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাঘাত ঘটায়। বিভিন্ন ধরনের মাথাব্যথা, তাদের উপসর্গ এবং সম্ভাব্য কারণগুলি বোঝা কার্যকরী ব্যবস্থাপনা এবং উপশমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাথায় যন্ত্রনা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। নিচে কিছু ধরন ও তাদেরর লক্ষণ দেওয়া হলো
চিন্তার মাথা ব্যাথা (Tension Headache)
টেনশনের মাথাব্যথা প্রায়ই পেশী সংকোচন এবং মানসিক চাপের ফলে হয়। এগুলি এপিসোডিক বা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং এটি সবচেয়ে সাধারণ ধরণের মাথাব্যথা।
উপসর্গ: নিস্তেজ, বেদনাদায়ক ব্যথা, কপালের চারপাশে অথবা মাথা ও ঘাড়ের পিছনে শক্ত হওয়া বা চাপ, মাথার ত্বক, ঘাড় এবং কাঁধের পেশীতে কোমলতা।
কারণ: স্ট্রেস, দুশ্চিন্তা, দুর্বল ভঙ্গি, চোয়াল চেপে যাওয়া বা দাঁত পিষে যাওয়া, ইলেকট্রনিক ডিভাইসের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে পেশীতে টান পড়া।
ক্লাস্টার মাথাব্যথা (Cluster Headache)
ক্লাস্টার মাথাব্যথা অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং চক্রাকার প্যাটার্ন বা গুচ্ছাকারে দেখা দেয় এবং প্রায়ই দিন অথবা বছরের একই সময়ে দেখা দেয়।। এ ধরনের মাথাব্যথা তুলনামূলকভাবে বিরল।
উপসর্গ: তীব্র, ছুরিকাঘাত অথবা পুড়ে যাওয়ার মত ব্যথা, সাধারণত এক চোখের চারপাশে, চোখের পাতা ঝুলে যাওয়া, চোখ লাল হওয়া, নাক বন্ধ হওয়া, অস্থিরতা।
কারণ: সঠিক কারণ অজানা, তবে হাইপোথ্যালামাসের (hypothalamus) অস্বাভাবিকতা এবং রক্ত প্রবাহের পরিবর্তন একটি ভূমিকা পালন করতে পারে।
মাইগ্রেনের ব্যাথা (Migraine Headache)
মাইগ্রেন হল একটি জটিল স্নায়বিক অবস্থা যার মধ্যে মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক কার্যকলাপ জড়িত, প্রায়শই অল্প সতর্কীকরণ আকারে শুরু হয় এবং তারপরে মাথাব্যথার পর্যায় দেখা দেয়।
উপসর্গ: থরথর করে ব্যথা, আলো, শব্দ এবং গন্ধের প্রতি সংবেদনশীলতা, বমি বমি ভাব, বমি, দৃষ্টিশক্তির ব্যাঘাত।
কারণ: জেনেটিক কারন, মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক কার্যকলাপ স্নায়ু সংকেতকে প্রভাবিত করা, সেরোটোনিনের (serotonin) মতো মস্তিষ্কের রাসায়নিকের পরিবর্তন।
হেমিক্রেনিয়া কন্টিনুয়া (Hemicrania Continua)
হেমিক্রেনিয়া কন্টিনুয়া হল একটি বিরল, ক্রমাগত মাথাব্যথা যা ক্রমাগত কিন্তু তীব্রভাবে ওঠানামা করে।
উপসর্গ: ক্রমাগত, হালকা থেকে মাঝারি ব্যথা সহ তীব্র ব্যথার, সাধারণত মুখ অথবা মাথার একপাশে, কখনও কখনও অন্য লক্ষণগুলোকে আরো বাড়িয়ে তোল।
কারণ: কারণটি অজানা তবে এটি ইন্ডোমেথাসিন (indomethacin) ওষুধের সাথে অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল।
আইস পিক মাথাব্যথা (Ice Pick Headache)
আইস পিক মাথাব্যথা হল তীব্র, ছুরিকাঘাত অথবা ঝাঁকুনি দেওয়া ব্যথা যা কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয় এবং দিনে একাধিকবার হতে পারে।
উপসর্গ: আকস্মিক, তীক্ষ্ণ, ছুরিকাঘাতে ব্যথা, সাধারণত মাথার একটি নির্দিষ্ট এলাকায় স্থায়ী হয়।
কারণ: স্নায়ু পথের সমস্যা অথবা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কর্মহীনতার ।
বজ্রপাতের মত মাথাব্যথা (Thunderclap Headache)
থান্ডারক্ল্যাপ মাথাব্যথা তীব্র এবং আকস্মিক ভাবে হয়ে এক মিনিটের মধ্যে তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। প্রায়শই একটি গুরুতর চিকিৎসা নেওয়ার ইঙ্গিত দেয়।
উপসর্গ: তাৎক্ষণিক, তীব্র ব্যথা, কখনও কখনও বমি বমি ভাব, বমি, চেতনা হারানো অথবা বিভ্রান্তি।
কারণ: সাবারাকনোয়েড হেমোরেজ (subarachnoid hemorrhage), সেরিব্রাল আর্টারি ডিসেকশন (cerebral artery dissection), রিভার্সিবল সেরিব্রাল ভাসোকনস্ট্রিকশন সিন্ড্রোম (reversible cerebral vasoconstriction syndrome) অথবা অন্যান্য গুরুতর ভাস্কুলার সমস্যা।
অ্যালার্জি অথবা সাইনাসের মাথাব্যথা (Allergy or Sinus Headache)
সাইনাসের মাথাব্যথাকে প্রায়ই মাইগ্রেন বলে ভুল করা হয় কিন্তু এটি সাইনাস কনজেশন (sinus congestion) অথবা সাইনোসাইটিসের (sinusitis) কারণে হয়।
উপসর্গ: মুখে ব্যথা এবং চাপ, বিশেষ করে কপাল, গাল এবং চোখের চারপাশে, সামনে ঝুকে নিচু হলে আরও বেশি খারাপ হয়।
কারণ: অ্যালার্জি, সংক্রমণ অথবা বিরক্তির কারণে সাইনাস প্যাসেজের প্রদাহ।
হরমোন মাথাব্যথা (মাসিক মাইগ্রেন) (Hormone Headache (Menstrual Migraine))
এই মাথাব্যথা মহিলাদের হরমোনের ওঠানামার সাথে যুক্ত, সাধারণত মাসিকের আগে, সময় বা পরে ঘটে।
উপসর্গ: মাইগ্রেনের মতো মাথাব্যথা, প্রায়ই সাধারণ মাইগ্রেনের চেয়ে বেশি গুরুতর, মাসিক চক্রের সাথে যুক্ত।
কারণ: মাসিক চক্রের সময় ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরনের মাত্রার ওঠানামা।
ক্যাফেইনের মাথাব্যথা (Caffeine Headache)
অত্যধিক ক্যাফিন খাওয়া অথবা হঠাৎ করে এর ব্যবহার বন্ধ করার ফলে ক্যাফেইনের মাথাব্যথা হতে পারে।
উপসর্গ: মাথাব্যথা, বিরক্তি, ক্লান্তি, মনোযোগ দিতে অসুবিধা।
কারণ: ক্যাফেইনযুক্ত পদার্থের অতিরিক্ত ব্যবহার অথবা আকস্মিক ছেড়ে দেওয়া।
পরিশ্রমের মাথাব্যথা (Exertion Headache)
তীব্র শারীরিক পরিশ্রম অথবা ক্রিয়াকলাপের সময় বা পরে মাথাব্যথা ঘটে।
উপসর্গ: মাথা ব্যথা, প্রায়শই মাথার উভয় পাশে, ব্যায়ামের সময় অথবা পরে ঘটে।
কারণ: কঠোর শারীরিক পরিশ্রম, বিশেষ করে যারা এতে অভ্যস্ত নন যার ফলে মাথার রক্তনালীতে রক্ত চলাচল বেড়ে যায়।
উচ্চ রক্তচাপের মাথাব্যথা (Hypertension Headache)
উচ্চ রক্তচাপের সাথে সম্পর্কিত মাথাব্যথা, যদিও উচ্চ রক্তচাপ থাকা সবাই এই মাথাব্যথা অনুভব করে না।
উপসর্গ: নিস্তেজ, অবিরাম মাথাব্যথা, বিশেষ করে মাথার পিছনে, শারীরিক পরিশ্রমের কারনে আরও খারাপ হতে পারে।
কারণ: উচ্চ রক্তচাপ, প্রায়ই কার্ডিওভাসকুলার সমস্যার অন্তর্নিহিত কারণে।
রিবাউন্ড মাথাব্যথা (Rebound Headache)
ব্যথার ওষুধের ঘন ঘন ব্যবহারের পরে রিবাউন্ড মাথাব্যথার বিকাশ ঘটে, যার ফলে চক্রকারে ব্যথা বাড়তে থাকে।
উপসর্গ: ব্যথার ওষুধ ব্যবহারের জন্য আরও বেশি হয়, যার ফলে ঔষধ ব্যবহার বৃদ্ধি পায়, যার কারনে একটি স্ব-স্থায়ী চক্র তৈরি হয়।
কারণ: ওভার-দ্য-কাউন্টার এবং প্রেসক্রিপশন ওষুধ সহ ব্যথা উপশমকারী ওষুধ অতিরিক্ত ব্যবহার বা অপব্যবহার।
পোস্ট–ট্রমাটিক মাথাব্যথা (Post-Traumatic Headache)
মাথাব্যথা যা মাথায় আঘাত বা আঘাতের পরে হয়, তীব্রতা এবং সময়কালের মধ্যে তারতম্য হয়ে থাকে।
উপসর্গ: নিস্তেজ অথবা ঝাঁকুনি দেওয়া মাথা ব্যথা, প্রাথমিক আঘাতের পরে প্রায়ই ক্রমাগত বা পুনরাবৃত্তি হয়।
কারণ: মাথায় আঘাত, আঘাত, মাথা বা ঘাড়ে আঘাত।
মেরুদণ্ডের মাথাব্যথা (Spinal Headache)
স্পাইনাল ট্যাপ বা এপিডুরালের (epidural) পরে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড (cerebrospinal fluid (CSF)) ফুটো হওয়ার ফলে মাথাব্যথা।
উপসর্গ: বসে বা দাঁড়িয়ে থাকলে মাথাব্যথা বেড়ে যায়, শুয়ে থাকলে কমে যায়, ঘাড়ে ব্যথা, বমি বমি ভাব এবং আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা।
কারণ: কটিদেশে খোঁচা অথবা এপিডুরাল ইনজেকশনের মতো চিকিৎসা পদ্ধতির সময় ডুরা ম্যাটারে (dura mater) খোঁচা লাগার কারণে মেরুদণ্ডের কলাম থেকে CSF ফুটো হওয়া।
সঠিক রোগ নির্ণয় এবং ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন ধরণের মাথাব্যথা এবং তাদের অনন্য লক্ষণগুলি বোঝা অপরিহার্য। যদি গুরুতর বা ক্রমাগত মাথাব্যথা অনুভব করেন, তবে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন এবং উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।